গল্প ১:
মেয়ের বিয়ে হচ্ছে, সুন্দর একজন জামায় এসে মেয়ের হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বাবা-মার কাছে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কিছু আছে?
গল্পটা একটু ভিন্ন!
দিলীপ, 70 বছর বয়স, এসেছেন সিরাজগঞ্জ থেকে।
অ্যাক্যাডেমিক কারণে হসপিটালে কয়েকদিন ইরেগুলার, সকালবেলা ওয়ার্ডে রোগী দেখতে গেলাম, গতকাল এডমিশন ছিল, সারারাত অপারেশন হয়েছে,কেউ বাদ পড়েছে কিনা সকালবেলা দেখার জন্য ওয়ার্ডে প্রতিটা ফাইল চেক করা হচ্ছে।
ভদ্রলোককে পেয়ে গেলাম, অজ্ঞান অবস্থায় আছেন সাথে তার বড় ছেলে! গতকাল রাত থেকে এই অবস্থা এখনো 24 ঘন্টা পর হয় নি।
মাথার সিটি স্ক্যান চেক করলাম, বড় ধরনের একটা রক্তক্ষরণ হয়েছে মাথার মধ্যে, জ্ঞানের মাত্রা অনেক কম!
সিদ্ধান্ত নিলাম খুব দ্রুত অপারেশন করে ফেলব, রোগীর লোকজনকে সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে ফেললাম অপারেশন করতে হবে!
ডিসিশান নিতে কষ্ট হচ্ছিল তাদের, মুখ চাওয়াচায়ি করছিল, খতিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম ঘটনা টা কি আসলে, কেন তারা এরকম করছে?
যা জানতে পারলাম তা বিষয়টা এরকম, ভদ্রলোকের বড় মেয়ের বিয়ে আজকে, গত কয়েকদিন তারপরও প্রচুর ধকল গিয়েছে, অনেক টাকা আয়োজন করতে হয়েছে, অনেক কেনাকাটা, দাওয়াত ছিল সব সম্পন্ন করেছেন।
মেয়ের সবকিছু ব্যবস্থা করতে গিয়ে নিজেরা যত্ন নেয়া হয়ে ওঠেনি, দীর্ঘদিনের প্রেসার এবং ডায়াবেটিস কোনটাই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি, অযত্নে-অবহেলায় ব্রেনের রক্তনালি ছিঁড়ে গেছে! অজ্ঞান অবস্থায় তাকে সিরাজগঞ্জ হাসপাতালে এবং সেখান থেকে আজকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়েছে!
বাসায় বড় মেয়ের বিয়ে চলছে, মেয়ে এখনো জানেনা তার বাবা কোথায় এবং কেমন আছে!
মানুষের নিয়তি এমন, সারা জীবন অন্যের জন্য আয়োজন করা হচ্ছে, নিজের ঠিক আছে কিনা সেটা জানার সময় হয়ে উঠেনি! হায়রে মানুষ!!
মেয়ের সংসার গুছিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, বাবা জগৎসংসারের হিসাব শেষ করে উপরে ওঠার চেষ্টা করছে!
গল্প:২
রাত বারোটায় ঘুমোতে যাবো, ঠিক সেই সময় টা আমার বন্ধু ফোন দিচ্ছিল বারবার। ফোন ধরলাম, ফোনের ওপাশে অনেক উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল ,তোমার সাহায্য জরুরী দরকার! আমি ফোনের ওপার থেকে চেষ্টা করলাম তার দুলাভাই এর কি হয়েছে সেটা বোঝার, ঘটনা শুনে যা বুঝতে পারলাম তিনি অজ্ঞান হয়েছেন সম্ভবত স্ট্রোক করেছেন। ঢাকার একটা বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করিয়াছেন, সেখানে কোন সিটি স্ক্যান এর ব্যবস্থা নেই।আমাকে বলামাত্র আমি বললাম তুমি ঢাকা মেডিকেলে তাড়াতাড়ি নিয়ে আসো আমি ব্যবস্থা করছি।বুঝতে পারছিলাম রোগীর অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো, এজন্য গরিবের হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেলে আসতে গাঁইগুঁই করছিল। কিন্তু এত রাতে ঢাকাতে আর কেইবা বসে আছে সেবা দেওয়ার জন্য। আমি জোরাজুরি করাতে সে রাজী হল, জরুরী বিভাগে এসে মাথার সিটি স্ক্যান করে মাথায় রক্তক্ষরণ ধরা পরল, মানে একটা স্ট্রোক করেছে। রোগী কিছু জরুরী ভিত্তিতে ভর্তি করে প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু হলো। একটু হিস্ট্রি নেওয়ার চেষ্টা করলাম আসলে ঘটনাটা কি, যা জানতে পারলাম তাও বিস্ময় জাগানিয়া, শুক্রবারে তার মেয়ের বিয়ে। মেয়ের বিয়েতে অনেক উত্তেজনা, আয়োজনের বিষয় ছিল, দীর্ঘদিনের আনকন্ট্রোল প্রেসারটা প্রতিশোধ নিয়েছে সুযোগ বুঝে,স্ট্রোক করে। সকালবেলা গিয়ে তাদের সাথে দেখা হল, রোগীকে দেখলাম কিছুটা স্ট্যাবল হয়েছে, সারারাত তারা মশার মধ্যে ফ্লোরে রোগী নিয়ে বসে ছিল, সবার মধ্যে চরম উৎকণ্ঠা! দুদিন পরেই মেয়ের বিয়ে, সবাই বলছে বিয়ের আয়োজন টা বন্ধ করে দিতে, বিয়ে আপাতত বন্ধ!
ডাক্তার হলে রোগীর অনেক কিছু বিষয় মাথায় নিতে হয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও পারিপার্শ্বিক বিষয়। আমি সব বিষয়গুলো বিবেচনা নিয়ে রোগীকে আবারো অ্যাসেসমেন্ট করলাম, রোগীর অবস্থার উন্নতি দেখে আমি তাদেরকে পরামর্শ দিলাম রোগীকে বাসায় নিয়ে যেতে এবং বিয়ের প্রস্তুতি যেন কোনোভাবেই বন্ধ না হয় সে বিষয়ে নিশ্চিত করতে। তাদেরকে আশ্বস্ত করলাম, আশাকরি দ্রুতই তাদের রোগী কিছুটা উন্নতি হবে।
বুঝতে পারছিলাম রোগীর সাথে আসা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের চোখে মুখে কিছুটা আশার আলো, মেয়ের বিয়ে বলে কথা! তারা সবাই বিয়ের দাওয়াত দিয়ে হসপিটাল থেকে বিদায় নিল
যাইহোক গত দিন দেখলাম আমার সেই বন্ধুর ফেসবুক প্রোফাইল থেকে গায়ে হলুদের প্রোগ্রামের লাইভ হচ্ছে!
আজ শুক্রবার নিশ্চিতভাবেই বিয়ে হচ্ছে!!
আমাদের জীবনটা কি অদ্ভুত রকমের তাই না?
দু'দিন আগেই যে বাড়িতে মৃত্যুর আনাগোনা ছিল, আজকে সেই বাড়িতে হলুদের বিয়ের আনন্দ!!
কি অদ্ভুত জীবন তাই না?
কি অদ্ভুত আমাদের জীবন ডাক্তারদের, হাসি কান্না দুঃখ সবকিছু আশেপাশে ঘুরঘুর করবে, কোনকিছুকেই স্পর্শ করা যাবে না, আপনাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন পআবেগ ছাড়াই!!
খুব ভালো লাগছে এই ভেবে যে তাদের একটা ভালো সিদ্ধান্ত কে ডাক্তার হিসেবে ইনফ্লুরেন্স করতে পারছি!
মানুষ হিসেবে এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কিছু আছে?
©ডাঃ গাউসুল আজম
Post a Comment