বয়োসন্ধিতে ছেলে ও মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন

 


বয়োসন্ধি ছেলে এবং মেয়ে উভয়েরই জন্য বেশ খানিকটা সংকটের সৃষ্টি বা সমস্যা ডেকে আনে। তাই বয়োসন্ধির সময় সন্তানের প্রতি অতিরিক্ত নজর দিতে হয়। তবে সাধারণভাবে বয়োসন্ধিকালে ছেলেদের যে সব সমস্যা হয় মেয়েদের সমস্যা হয় তার থেকে বেশি। আজকের আসরে তাই বয়োসন্ধিকালে মেয়েদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করব। এ আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. মাহেনাজ আফরোজ।


বয়োসন্ধিতে এসে ছেলে এবং মেয়ে উভয়ই দেহে এবং মনে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ছেলেদের মুখে দাঁড়ি গোফের রেখা ফুটে উঠতে থাকে। স্বর বদলে যায়। অন্যদিকে মেয়েদের দৈহিক পরিবর্তন ঘটার সাথে সাথে তার আরো কিছু পরিবর্তন ঘটে। নানা আলোচনার কারণে আজ আমরা জানি হরমোনের কারণে ছেলে ও মেয়েদের দেহে এ সব পরিবর্তন দেখা দেয়। বয়োসন্ধির সময়ের এ সব পরিবর্তন অনেক সময়ই কোনো কোনো মেয়ের জন্য বেশ খানিকটা সমস্যার সৃষ্টি করে। এ কারণে আলোচনার শুরুতেই এ সমস্যার দিকে আলোকপাত করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. মাহেনাজ আফরোজ। বয়োসন্ধিকালে একজন মেয়ের জীবনে যে সব পরিবর্তন দেখা দেয় তা নয় থেকে ১৩ বছর বয়সের মধ্যেই সাধারণভাবে তা ঘটে থাকে। একটি শিশু যখন কৈশোরে পা দেয় তখন স্বাভাবিক ভাবেই সে বেশ আবেগপ্রবণ থাকে। 


এ সময় তারা যে কোনো ব্যাপার দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায়। এ কারণে অনেকেরই মনে হয়, শান্তশিষ্ট ছেলে বা মেয়েটি হঠাৎ কেন রাগী বা মারমুখো হয়ে উঠল। এ সময়ে মেয়েদের দৈহিক কিছু পরিবর্তন দেখা দেয়। এ সব পরিবর্তনকে বয়সের কারণে স্বাভাবিক পরিবর্তন হিসেবে ধরে নিতেই হবে। সাধারণভাবে ১১ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে মেয়েদের নিয়মিত ঋতুচক্র শুরু হয়ে যায়। একে কেউ কেউ মাসিক বা পিরিয়ড বলে অভিহিত করেন। যে কিশোরী নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার দাবার গ্রহণ করে এবং দৈহিক পুষ্টির হার ভাল তাদের ক্ষেত্রে এ পরিবর্তন অর্থাৎ পিরিয়ডের ব্যাপারটি একটু আগে দেখা দিতে পারে। এ নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। অন্যদিকে যদি কেউ অপুষ্টিতে ভোগে তবে তাদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি একটু দেরিতে আসতে পারে। কিন্তু একটি জিনিস খেয়াল রাখতে হবে, বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখতে হবে যে যদি কোনো মেয়ের ১৬ বছরের মধ্যেও এ চক্র শুরু না হয় তবে আর দেরি না করে তাকে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখাতে হবে। একজন মেয়ের মা হওয়ার জন্য এই চক্রের প্রয়োজন রয়েছে। কত শতাংশ মেয়ে মাসিক চক্র নিয়ে সমস্যা পড়ে বাংলাদেশে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে উপ-মহাদেশের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১০ শতাংশ মেয়ের এ ধরণের সমস্যা দেখা দিতে পারে। 


কাজেই কোনো মেয়ের ক্ষেত্রে ষোল বা আঠারো বছরের মধ্যে যদি এ চক্র শুরু না হয় তা হলে ধরে নেয়া যেতে পারে সে কখনো আর মা হওয়ার যোগ্য হবে না। কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় হরমোনের জটিলতার কারণে এ চক্র শুরু হচ্ছে না। হরমোনের গোলোযোগের কারণে যদি এ ধরণের গোলোযোগ দেখা দেয় তবে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে তা দূর করা যেতে পারে। আবার কখনো কখনো ক্যান্সার বিষয়ক জটিলতার কারণেও এ ধরণের সংকট দেখা দিতে পারে। মাসিক চক্র নিয়ে আরেকটি মারাত্মক জটিলতার কথা তুলে ধরেন ডা.মাহেনাজ আফরোজ। তিনি জানান, অনেক সময় দেখা যায় কোনো কোনো মেয়ের রক্তশ্রাব শরীরেই জমা হচ্ছে তা বাইরে বের হচ্ছে না। সময়মত এটা নির্ণয় করা না গেলে তাতে কিশোরী মেয়েটা অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে। এই সমস্যার উপসর্গ হিসেবে কখনো কখনো কিশোরী মেয়েটি অভিযোগ করতে পারে একটি নির্দিষ্ট সময়ে তার তলপেটে ব্যাথা হচ্ছে এবং তার পেট ফুলে উঠছে। তবে এ উপসর্গ সব সময় দেখা নাও যেতে পারে। তবে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হলে তিনি সহজেই এ ধরণের অসুবিধাগুলো নির্ণয় করতে পারবেন।


এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন আর তা হলো, কখনো কখনো দেখা যায় এ চক্র শুরু হওয়ার পর তা নিয়মিত সময়ে হচ্ছে না। প্রথম প্রথম এ রকম সমস্যা যে কোনো মেয়েরই হতে পারে। তবে তা নিয়ে উৎকন্ঠা বা চিন্তা করার কোনো কারণ নেই । কারণ এক বা দুই বছরের মধ্যেই এ চক্র স্বাভাবিকভাবে নিয়মিত হয়ে যায়। তবে এ সময় কারো কারো অধিক রক্তপাত হয়। এ কারণে মেয়েটি রক্তহীন হয়ে যেতে পারে। অভিভাবকের এ দিকে নজর রাখতে হবে। কারণ রক্তাল্পতা বা এনেমিয়া থেকে পরবর্তীতে স্বাস্থ্যহানিকর নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। কাজেই যদি কোনো মেয়ের অধিক রক্তপাত হয় তবে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। 


বয়োসন্ধিকালে ছেয়ে মেয়েরা আবেগী হয়ে পড়ে। একইভাবে আবেগী হয়ে পড়ে নারী তার বিশেষ বয়সে। অর্থাৎ যখন তার মেনোপজ ঘটে সে সময়টিতে। এতে বোঝা যাচ্ছে, নারী জীবনের শুরুতে এবং নারী জীবনের শেষ লগ্নে আবেগ দেখা দেয়। আমাদের এমন প্রশ্নের জবাবটি ডা.মাহেনাজ আফরোজ ইতিবাচক ভাবে দেন। তারপর তিনি আরো জানান, এ দুই সময়ই কৈশোর এবং বার্ধক্যে এসে আবেগী হয়ে উঠে নারী । কিন্ত কৈশোরে যতোটা আবেগ প্রবণ হয়ে পড়ে ঠিক ততোটা আবেগ প্রবণ হতে দেখা যায় না মেনোপজের সময়। দু'সময়ে আবেগ প্রবণ হলেও তার ধরণ বেশ কিছুটা ভিন্ন হয়। বয়োসন্ধিকালে সন্তানের সাথে আচরণের ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুটি তার কৈশোর অতিক্রম করছে। সে এগিয়ে চলছে তার পূর্ণতার দিকে। এ সময় তার নিজের ব্যাক্তিত্ব তৈরি হচ্ছে। কাজেই তার মধ্যে আপাত দৃষ্টিতে তাকে খানিকটা আবেগী এবং জেদী মনে হতে পারে। 


তবে এ সময় বাবা-মা বা অভিভাবকের বড় একটি ভূমিকা রয়েছে। তারা সন্তানের কাছে থাকবেন। তাকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। তার সন্তান সব কিছুতেই প্রতিক্রিয়া দেখাবে এটা মেনে নিতে হবে। বাবা মাকে একই সাথে প্রমাণ করতে হবে যে তারা সন্তানের ভাল চান। এবং তার বন্ধু এটা বিশ্বাস করাবেন। এ সময় সন্তান বন্ধু খুঁজতে যেয়ে হয়ত বিপথে পা বাড়াতে পারে। বা কোনো জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। বাবা-মা যদি সতর্ক না হয় তা হলে শেষ পর্যন্ত মুশকিল হতে পারে। বয়োসন্ধিকালে সন্তান বিশেষ করে মেয়েকে অন্তত একবার একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া ভাল। তাতে মেয়েটির কোনো সমস্যা থাকলে তা আগে ভাগেই ধরা পড়তে পারে। চিকিৎসাও শুরু হতে পারে দ্রুত। তাই সবাই সাধ্যমত এ বিষয়টি পালনের চেষ্টা করবেন।

Post a Comment

Previous Post Next Post