বর্তমান জীবনে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যাটির সচরাচর। শুধু বয়স্কদের নয়, অনেক তরুণদের ক্ষেত্রেও এখন উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা দেখা দেয়। এই সমস্যার কারণে দেহে বিভিন্ন জটিলতা তৈরি হয়।
রক্তচাপ:
রক্তচাপ (ইংরেজি: blood pressure) হল রক্তনালীর গাত্রের উপর রক্ত কর্তৃক প্রযুক্ত চাপ।
রক্তচাপের ধাপ বা পর্যায়
1. Systolic blood pressure ( সংকোচন রক্তচাপ)- ৯০ থেকে ১৪০ মিমি।
2. Diastolic blood pressure ( প্রসারন রক্তচাপ ) - ৬০ থেকে ৯০ মিমি।
রক্তচাপ বা ব্লাড প্রেশার ৩ রকমের
1. Norm tension or Normal blood pressure ( স্বাভাবিক রক্তচাপ ) : এ ক্ষেত্রে রক্ত চাপ- সিস্টোলিক ৯০ থেকে ১৪০ মিমি এবং ডায়াস্টোলিক ৬০ থেকে ৯০ মিমি এর মধ্যে থাকবে।
2. Hypotension or low blood pressure ( নিম্ন বা লঘু রক্তচাপ ) : এ ক্ষেত্রে রক্ত চাপ - সিস্টোলিক ১০০ মিমি থেকে নিচে ও ডায়াস্টোলিক ৭০ মিমি থেকে নিচে থাকে। লো প্রেসার কোন রোগ নয়।
3. Hypertension or high blood pressure ( উচ্চ রক্তচাপ ) : এ ক্ষেত্রে রক্ত চাপ - সিস্টোলিক ১৪০ এর বেশি ও ডায়াস্টোলিক ৯০ মিমি থেকে বেশি হয়।
উচ্চ রক্তচাপের এর ৬টি ভাগ আছে
১) ( High Normal ) হাই নরমাল: সিস্টোলিক ১৩০ থেকে ১৪০ এবং ডায়াস্টোলিক ৮০ থেকে ৯০ হলে।
২) ( HTN-Grade-1) উচ্চ রক্তচাপ -গ্রেড-১: সিস্টোলিক ১৪০ থেকে ১৫০ এবং ডায়াস্টোলিক ৯০ থেকে ১০০ পর্যন্ত।
৩) ( HTN-Grade-2) উচ্চ রক্তচাপ- গ্রেড-২: সিস্টোলিক ১৫০ থেকে ১৬০ এবং ডায়াস্টোলিক ১০০ থেকে ১১০ পর্যন্ত।
৪) ( HTN-Grade-3) উচ্চ রক্তচাপ-গ্রেড-৩: সিস্টোলিক ১৬০ থেকে ১৮০ এবং ডায়াস্টোলিক ১১০ থেকে ১২০ পর্যন্ত।
৫) ( HTN- Crisis) উচ্চ রক্তচাপ- ক্রাইসিস: এক্ষেত্রে সিস্টোলিক ১৮০ এর উপরে ও ডায়াস্টোলিক ১২০ এর উপরে হয়। এটা অত্যন্ত জরুরী অবস্থা।
৬) ( Isolated Systolic HTN) শুধুই সিস্টোলিক উচ্চ রক্তচাপ: এক্ষেত্রে রক্তচাপ সিস্টোলিক বাড়বে ১৫০ থেকে উপরে কিন্তু ডায়াস্টোলিক রক্ত চাপ স্বাভাবিক থাকে।
রক্তচাপ বা ব্লাড প্রেসার শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বা ধমনিক প্রবাহ। প্রতিটি হৃদস্পন্দনের সময় একবার সর্বোচ্চ চাপ (সিস্টোলিক) এবং সর্বনিম্ন চাপ (ডায়াস্টোলিক) হয়, যা সাধারণত ঊর্ধ্ব বাহুর ব্রাকিয়াল ধমনিতে দেখা হয়। রক্তচাপ রক্তসংবহনে ও জালকতন্ত্রে পরিস্রাবণ প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে। এই প্রক্রিয়া রক্ত থেকে কোষে পুষ্টি সরবরাহ, মূত্র উৎপাদন প্রভৃতি শারীরবৃত্তীয় কাজের সঙ্গে জড়িত।
সিস্টোলিক চাপ ওপরে এবং ডায়াস্টোলিক চাপ নিচে লিখে রক্তচাপ প্রকাশ করা হয়। হৃৎপিণ্ডের সংকোচণের কারণে মানুষের ধমনি ও শিরায় রক্তের চাপ সৃষ্টি হয়। এর ফলে যে চাপ অনুভূত হয় তাকে সিস্টোলিক চাপ বলে। যেমন ১২০/৮০ এর একক মি.মি. পারদ (চাপের একটি একক)। আবার হৃৎপিণ্ডের প্রসারণের ফলে যে চাপ অনুভূত হয় তাকে ডায়াস্টোলিক চাপ বলে।
মানুষের শরীরে ৮০/১২০ হলো আদর্শ রক্তচাপ, ৮০/১৩০ হলো সবচেয়ে অনুকূল রক্তচাপ এবং ৮৫/১৪০ হলো সর্বোচ্চ।
কোনো অসুখে বা অন্য অজানা কারণে রক্তচাপ বেড়ে গেলে তাকে হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ বলে এবং রক্তচাপ কমে গেলে তাকে হাইপো টেনশন বা নিম্ন রক্তচাপ বলে।
উচ্চ রক্তচাপ
হাইপারটেনশনের আরেক নাম উচ্চ রক্তচাপ, যাকে HTN দিয়ে প্রকাশ করা হয়। যখন কোনো ব্যক্তির রক্তের চাপ সব সময়েই স্বাভাবিকের চেয়ে ঊর্ধ্বে থাকে, তখন ধরে নেওয়া হয় তিনি হাইপারটেনশনে ভুগছেন। কারো রক্তচাপ যদি উভয় বাহুতে ১৪০/৯০ মি.মি. বা তার ওপরে থাকে, তাহলে তার উচ্চ রক্তচাপ হয়েছে বলা যেতে পারে।
ঝুঁকি: শরীরের অন্যান্য অঙ্গের ওপর স্বল্প থেকে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে এই উচ্চ রক্তচাপ। বিশেষত স্ট্রোক, হার্ট ফেইলিওর, হৃিক্রয়া বন্ধ, চোখের ক্ষতি এবং বৃক্ক বা কিডনি বিকলতা ইত্যাদি রোগের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
উচ্চ রক্তচাপের কারণ
(১). অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা।
(২). পরিবারে কারও উচ্চরক্তচাপ থাকলে।
(৩). নিয়মিত ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম না করলে।
(৪). দীর্ঘদিন ধরে ঘুমের সমস্যা হলে।
(৪). শারীরিক ও মানসিক চাপ থাকলে।
(৫). ধুমপান, মদ্যপান বা অতিরিক্ত ক্যাফেইন জাতীয় খাদ্য/ পানীয় খেলে।
(৭). প্রতিদিন ছয় গ্রাম অথবা এক চা চামচের বেশি লবণ খেলে।
তবে ধারণা করা হয়, প্রায় ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার কারন হিসেবে লবণের ব্যবহারকে দায়ী করা হয়।
উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ
(১). অস্বস্তি বোধ করা।
(২). নিয়মিতভাবে অতিরিক্ত মাথা ব্যথা।
(৩). ঘাড় ব্যথা করা।
(৪). চোখে ঝাপসা দেখা।
(৫). নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া অথবা নাক দিয়ে রক্ত পড়া।
(৬). রাতে ভালো ঘুম না হওয়া ।
(৭). বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া ।
(৮). অনেক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলা।
(৯). মাঝেমাঝে কানে শব্দ হওয়া ।
(১০). অল্পতেই রেগে যাওয়া বা অসুস্থ হয়ে শরীর কাঁপতে থাকা।
করণীয়
চিকিৎসকরা মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের রক্তচাপের জন্য ওজন কমানো, ধূমপান ছেড়ে দেওয়া এবং নিয়মিত হালকা ব্যায়ামকে চিকিৎসার প্রথম ধাপ হিসেবে ধরেন। যদিও ধূমপান ছেড়ে দেওয়ায় সরাসরি রক্তচাপ কমে না; কিন্তু উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে এটি সম্পৃক্ত, কারণ এটি ছেড়ে দিলে উচ্চ রক্তচাপের বেশ কিছু উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে আসে। যেমন স্ট্রোক অথবা হার্ট অ্যাটাক। মৃদু উচ্চ রক্তচাপ সাধারণত খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, ব্যায়াম এবং শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সারিয়ে তোলা যায়। ফল, শাকসবজি, স্নেহবিহীন দুগ্ধজাত খাদ্য এবং নিম্নমাত্রার লবণ ও তেলজাতীয় খাদ্য উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। এ ছাড়া পরিবেশগত চাপ যেমন উঁচু মাত্রার শব্দের পরিবেশ বা অতিরিক্ত আলো পরিহার করাও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য উপকারী। এর পরও যাঁরা মাঝারি থেকে উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন, তাঁদের রক্তচাপ নিরাপদ মাত্রায় নিয়ে আসার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শে অনির্দিষ্টকালের জন্য ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়।
নিম্ন রক্তচাপ
নিম্ন রক্তচাপ বা Low Blood pressure শব্দটা বেশ প্রচলিত। মেডিক্যাল পরিভাষায় নিম্ন রক্তচাপ হলো দেহের রক্ত সংবহনতন্ত্রের এমন একটি অবস্থা, যেখানে রক্তের সিস্টোলিক চাপ ৯০ মি.মি. পারদের নিচে এবং ডায়াস্টোলিক চাপ ৬০ মি.মি. পারদের নিচে থাকে।
লো প্রেসার (low pressure) বা নিম্ন রক্তচাপের কারণ
১). অতিরিক্ত পরিশ্রম
২). শরীরে পানিশূন্যতা
৩). দুশ্চিন্তা
৪). অপুষ্টি
৫). সঠিক খাবার না খাওয়া
৬). অপর্যাপ্ত ঘুম
৭). ডায়রিয়া
৮). বদহজম
৯). রক্তপাত
১০). রক্তশূন্যতা
১১). গর্ভাবস্থায়
১২). হরমোনের ভারসাম্যহীনতা।
লো প্রেসার বা নিম্ন রক্তচাপের লক্ষণ
এক). মাথা ঘোরানো বা মাথা হালকা অনুভূত হওয়া।
দুই). বসা থেকে উঠে দাঁড়ালে মাথা ঘুরে যাবে বাবা সম্মুখীন হয়ে যাওয়া।
তিন). বমিভাব হওয়া।
চার). মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
পাঁচ). ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া।
ছয়). প্রস্রাব কমে যাওয়া ।
সাত). অস্বাভাবিক দ্রুত হৃদ কম্পন হওয়া ।
আট). খুব বেশি তৃষ্ণা অনুভূত হওয়া ।
নয়). শারীরিক বা মানসিক অবসাদ ।
দশ). চোখে অন্ধকার বা ঝাপসা দেখা।
ঝুঁকি: যাদের রক্তচাপ অস্বাভাবিক হারে কম, তাদের হৃিক্রয়া, অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি কিংবা মস্তিষ্কজাত সমস্যা থাকতে পারে। এই রক্তচাপ বজায় থাকলে মস্তিষ্ক এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গে রক্ত সরবরাহ কম থাকার কারণে সেখানে অক্সিজেন ও পুষ্টির অভাব হতে পারে, যা জীবনের জন্য হুমকির কারণ হতে পারে।
করণীয়: আলু, ডিম, মাছ, মাংস, ছানা, বাদাম, সবুজ শাক ইত্যাদি এবং লবণযুক্ত খাবার গ্রহণ, খাদ্যে কিছু ইলেকট্রোলাইট (গ্লুকোজ ও স্যালাইন) যোগ, সকালে ক্যাফেইন গ্রহণ সহায়ক হতে পারে।
আমাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গের সুস্থতার জন্য রক্তচাপকে নিরাপদ মাত্রার মধ্যে রাখা প্রয়োজন। তাই নিয়মিত রক্তচাপ মাপার অভ্যাস করুন আর দেহমনকে সুস্থ রাখুন।
- [ডা:মোহাম্মদ আলী, চীফ কনসালট্যান্ট, বিজিএমইএ]
Post a Comment