যৌনতার আবার স্বাস্থ্য আছে নাকি? এ প্রশ্ন চিরন্তন। এতদিন শারীরিক স্বাস্থ্য , মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষকরা বিভিন্নভাবে গবেষণায় ব্যস্ত ছিলেন। গত কয়েক দশক ধরে যৌন স্বাস্থ্যের ব্যাপারে তারা বিশেষ বিশেষ পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তারই কিছু কিছু অনুবাদ আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম।
সেক্স যেমন একটি আনন্দের বিষয় তেমনি দম্পতিদের মাঝে মানসিক চাপের বোঝা আকারে দেখা দেয়। দাম্পত্য জীবনে আপনি যখন পুরোপুরিভাবে সন্তুষ্ট ঠিক তখনি আপনার বন্ধু - বান্ধবের কাছে নানা কথা শুনে আপনার মনে আপনার কাজের ক্ষমতা সম্পর্কে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। অতি সাধারণভাবে বলা যায়- কার্যক্ষমতা যেমনই হোক না কেন, স্বামী - স্ত্রী সন্তুষ্ট থাকলে এতে মাথা গরম করার কোনো কারণ নেই। সাধারণ লোকেরা অন্যের কথা শুনে মিলনের সংখ্যা ও স্থায়িত্বকাল নিয়ে উদ্বিগ্ন হন। অনেক ধরনের বিদঘুটে তথ্যও উপস্থাপন করা হয়। এতে করে ভুল বোঝার সম্ভাবনা থাকে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , কিছু কিছু জরিপে বলে প্রতি সপ্তাহে দম্পতিরা গড়ে ৩ বার মিলন করেন। এমন সংখ্য শূন্য থেকে শুরু হয়ে ২০ বার পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে রয়েছে। এমন নয় যে আপনাকে এই জরিপের হিসাব মেনে চলতে হবে। আপনাদের মিলন সংখ্যা ও কাজ - কর্মে নিজেরা সন্তুষ্ট থাকলে কোনোরূপ জরিপে মন দেয়ার প্রয়োজন নেই।
সাধারণ যৌন স্বাস্থ্য ও ব্যবহার সামাজিক ও ধর্মীয় ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। তাই কোনটি স্বাভাবিক আর কোনটি অস্বাভাবিক পার্থক্য করা খুবই কঠিন। যেমনটি বলা যায়, আমেরিকান যুবক - যুবতীদের ক্ষেত্রে বা জার্মানির ক্ষেত্রে। তাদের জীবনে তারা বিবাহিত হতে এক রকম নারাজ। কিন্তু বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হয়েও তারা যৌন স্বাস্থ্যের প্র্যাকটিস চালিয়ে যাচ্ছেন। এটা সে দেশের ধর্ম , কৃষ্টি ও সামাজিকতার সাথে সম্পর্কযুক্ত।
কিন্তু মুসলমান হিসেবে আমরা এ নিয়ম ফলো করি না , ধর্মীয় নিয়মে বিবাহের বাহিরে আমরা শারীরিক সম্পর্ক সমর্থন করি না। এভাবে দেশ, ধর্ম কৃষ্টি-কালচার ও সামাজিকতা হিসেবে যৌন স্বাস্থ্য ও ব্যবহারের ভিন্নতা রয়েছে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন "তাই যৌন চিন্তা ও ব্যবহার যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো শারীরিক বা মানসিক কষ্টের সৃষ্টি না করে , সম্পর্কে টানাপোড়েনের সৃষ্টি না করে বা জীবন - যাত্রায় অন্য কোনোভাবে বিঘ্নের সৃষ্টি না করে ততোক্ষণ পর্যন্ত আপনি স্বাভাবিক যৌনস্বাস্থ্য ধারণ করে আছেন বলে মেনে নেয়া যায় । "
দম্পতিরা তাদের নিজেদের অনুভূতি নিয়ে একে অপরের সাথে খোলামেলা আলোচনা করুন। যেমন- মিলনে তাদের আনন্দ, উত্তেজনা, ইচ্ছা বাড়া বা কমে যাওয়া বিষয়ে অথবা মানসিক চাপ , অপরাধবোধ বা দায়িত্ববোধ থেকে যৌন সম্পর্ক পালন করছেন এ ধরনের অনুভূতি কাজ করে কি না? মিলনের পরে তারা সন্তুষ্ট , রিলাক্স বা জীবনটাকে অনুভব করেন কি না? নাকি তাদের অনুভূতিতে রাগ, ক্ষোভ, উষ্মা বা অতৃপ্তি প্রকাশ পায়।
মিলনের পরে যদি দু'জনের মধ্যে একটা ভালবাসার অনুভূতি জন্মায় তাহলে এটি সবচেয়ে ভাল। অপরদিকে না - সূচক মনোভাব আসলেই সমস্যার সৃষ্টি করে।
যৌন অনুভূতি বা যৌন ইচ্ছা একেক জনের একেক রকম হতে পারে। কারণ- এটি যেহেতু তাদের জীবনের পরিবেশের সাথে নির্ভরশীল। পারিপার্শ্বিকতার সাথে সাথে দম্পতিদের মনের ইচ্ছা উঁচু - নিচু হয়। কিন্তু যদি দেখা যায় সব কিছু ঠিক থাকার পরেও দম্পতিদের যৌন ইচছা কম তাহলে এ বিষয়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া ভাল।
কিন্তু যদি যৌন ইচ্ছা পরিমাণে বেশি তারতম্য হয় , এই ইচ্ছার দরুন সম্পর্কে টানাপোড়েন হয় , তাহলে এটি পারিবারিক সমস্যা সৃষ্টি করে । যে সঙ্গীর যৌন ইচ্ছা কম, তিনি এটিকে মানসিক চাপ মনে করেন এবং কতকটা নিমরাজি হয়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন । দীর্ঘ মেয়াদি মাত্রায় এটি দুঃখ , ক্ষোভ ও রাগ আরও বেশি করে তৈরি করে । ফলশ্রুতিতে যৌন ইচ্ছা আরও কমে যায় । অপর দিকে যে সঙ্গীর ইচ্ছাটা বেশি থাকে তিনি নিজেকে ভালবাসার অযোগ্য বলে হীনমন্যতায় ভোগেন । ফলে তার মনে ‘ বঞ্চিত হচ্ছি ' বলে ধারণাটা আরও বাড়তে থাকে এবং সে ব্যক্তি যার কিনা সেক্স ইচ্ছা বেশি তিনি তার স্ত্রী বা স্বামীকে যৌন মিলন করার জন্য বারবার চাপ দিতে থাকেন ।
ফলে সাইকোলজিতে দেখা যায়, এক জনের ইচ্ছা বাড়তেই থাকে, আরেক জনের কমতেই থাকে। একটি চক্রের মধ্যে আবদ্ধ থাকেন তারা, এই ধরনের অসামঞ্জস্য একটি জটিল আকার নিতে পারে এবং অনেক দিন ধরে থাকতে পারে, সে ক্ষেত্রে মনোচিকিৎসকের হস্তক্ষেপের দরকার হয়।
মনোচিকিৎসক এ ব্যাপারটা নিয়ে দু'জনার সাথে কথা বলেন । যার ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা কম থাকে তাকে ব্যাপারটা সহজভাবে এবং কোনো মানসিক চাপ ছাড়া নিতে আহ্বান করেন এবং তিনি উপদেশ দেন যার ইচ্ছা বেশি তার সাথে যতবার দরকার মিলিত হতে । কারণ এটি সাধারণ স্বাস্থ্য ও যৌন স্বাস্থ্যের জন্য দরকারি । অপরদিকে আবার মনোচিকিৎসকরা যার ইচ্ছা কম সে সঙ্গীকে চাপ দিতে বারণ করেন । যখনই এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয় , তখন যে সঙ্গীর ইচ্ছা কম সেই সঙ্গী অপর সঙ্গীকে আনন্দ দিতে পারছেন এটি মনে করেই খুশি হন । আর যে সঙ্গীর ইচ্ছা বেশি তিনি মনে করেন তাকে এ ব্যাপারটায় যথেষ্ট পরিমাণ গুরুত্ব ও সঙ্গ দেয়া হচ্ছে । এতে করে তার মনের বিশ্বাস বেড়ে যায় ও মনে আস্থা আসে ।
অনেক দম্পতির ক্ষেত্রে দেখা যায় এই পদ্ধতিতে যার ইচ্ছা কম তার ইচ্ছাটা একটু বাড়ে আর যার ইচ্ছা বেশি তার ইচ্ছাটা একটু কমে । সোজা কথায় দম্পতিদের একজনার ইচ্ছা বেশি থাকলে আর সেখানে না - সূচক শুনলে সেখানে ইচছা আরো বেড়ে যায় ।
আমরা যা বলতে চাই তা হলো , দু'জনার ইচ্ছার একটা সমন্বয় করা দরকার । অনেক দম্পতি এই উপদেশটা মেনে নেন না । অনেকে মনে করেন যতক্ষণ পর্যন্ত পুরোপুরি মনের ইচ্ছা না আসবে ততোক্ষণ পর্যন্ত কোনো কাজে যাওয়া উচিত নয় বা অনেকে মনে করেন যৌন ইচ্ছার প্রকাশ শুধু দৈহিক মিলনেই হয় না আরো অনেক পদ্ধতি রয়েছে ।
অনেক ক্ষেত্রে সঙ্গীর বিশেষ যৌন ইচ্ছা দাম্পত্য কলহের সৃষ্টি করে । নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এই জটিলতা নিরসন করা যায় । তবে শোনার ইচ্ছা থাকতে হবে । একে অপরকে দোষী করা চলবে না বা কটু মন্তব্য করা যাবে না ।
মোদ্দা কথা সেই , নির্দিষ্ট যৌন ব্যবহার ক্ষতি করে কি - না । যিনি বিশেষ যৌন ইচ্ছা বা ব্যবহার করার অনুরোধ করবেন যদি উভয়ের সম্মতি না থাকে , সেক্ষেত্রে বারংবার অনুরোধ না করাই ভাল । যৌন কামনা , ইচ্ছা বা সন্তুষ্টি দম্পতির অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে । যেমন আত্মবিশ্বাস , দুশ্চিন্তামুক্ত পরিবেশ , মানসিক ও দৈহিক উদ্দীপক বাস্তব ব্যবহার ও সেই বিষয়ে মনোযোগের ক্ষমতা ও চিন্তা ।
যে কোনো জিনিস যা ওপরের কারণগুলোর ব্যাঘাত ঘটায় সেগুলো মিলনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে । নিয়মিতভাবে যদি ঐ উপাদানগুলো অনুপস্থিতি থাকে তাহলে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সৃষ্টি হয় ।
আত্মবিশ্বাস হচ্ছে সেই বিশ্বাস যাতে একজন সঙ্গী মনে করে যে সে ঠিকভাবে কাজটি করতে পারবে । নিজেকে আকর্ষণীয় মনে করে এবং সঙ্গীর ইচ্ছাকে মূল্য দেয় । একে অপরকে হুমকি দিলে এ ব্যাপারটি আরও খারাপ হয় ।
যে কোনো ধরনের দুশ্চিন্তা যৌনক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায় । তাৎক্ষণিকভাবে কিছু করতে পারবে কি - না এই দুশ্চিন্তায় তাদের ইচ্ছা ও কাজের ক্ষমতা কমে যায় । হয়ত বা ব্যর্থ হব এই মনোভাবও বেশ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে । যৌন ইচ্ছা বাড়ানোর জন্য সাধারণভাবে মনের চিন্তা ভাল কাজ দেয় ।
কম আত্মবিশ্বাস , বিক্ষিপ্ত চিন্তা - ভাবনা , মন মরে যাওয়া ইত্যাদি ক্ষমতা ও ইচ্ছাকে হ্রাস করে।
যৌন কাজে যে কোনো ধরনের ব্যর্থতা যেমন- দক্ষতা কম , যথেষ্ট শক্ত না হওয়া , কম সেক্স ইচ্ছা , চরম আনন্দ না পাওয়া , দ্রুত স্খলন এবং যে কোনো ধরনের সমস্যার জন্য প্রথম অবস্থায় এসকল দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, দম্পতিদের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব, পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার অভাব, বিশ্বাসের অভাব, পারস্পরিক সম্পর্কের ঘাটতি ইত্যাদি কে দায়ী করা হয়। তাই, যৌনস্বাস্থ্যের সাথে এ সকল বিষয়গুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
Read also:
ডা. মোঃ ফাইজুল হক
Post a Comment