আমাদের অনেকের মনে Wet Dream বা Nocturnal Emission বা স্বপ্নদোষ নিয়ে অনেক অজ্ঞতা, ভ্রান্ত ধারণা এবং এর ফলে অহেতুক ভয় কাজ করে। কারো খুব বেশি বেশি স্বপ্নদোষ হয়। কারো বছরেও একবার হয়না! দুটো বিষয় নিয়েই ভুক্তভোগীরা হয়রান, পেরেশান! আজ স্বপ্নদোষ নিয়ে ভাইদের কিছু কমন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবো ইনশা- আল্লাহ!
স্বপ্নদোষ কেন হয়?
- এটা স্রষ্টা প্রদত্ত দেহের একটা ক্রিয়া। কোন রোগ বা পাপ নয়। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক বিষয়। একদমই ক্ষতিকর কিছু নয়। মেডিকেল সাইন্সের মতে এটা একটা নরমাল "ফিজিওলজিক্যাল" ব্যাপার। মানে "সাধারণ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া"... জ্বী, ঠিকই শুনেছেন! এটা একটা "সাধারণ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া"!
তাহলে কারো মাসে দু/একবার, কারো ডেইলি একবার, আবার কারো বছরে একবার কেন হয়?
- আগেই বলেছি যে, এটা শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। আর সবার শারীরিক ক্রিয়া একরকম নয়। দেহের এনজাইম এবং হরমোনাল এক্টিভিটি, মেটাবলিজম এবং বায়োফিজিক্যাল ব্যাপার গুলো একেক জনে একেক রকম। যেমন, কেউ বরফ চিবিয়ে খেয়ে ফেলে, আবার কেউ ঠাণ্ডা পানি খেলেই টনসিল ফুলে যায়! এ কারনেই কারো বছরে একবার, কারো দৈনিক একবার করে স্বপ্নদোষ হলেও ব্যাপারটা নিজ নিজ ক্ষেত্রে "নরমাল"।
আমার কখনোই স্বপ্নদোষ হয়নি/ আমার একেবারেই স্বপ্নদোষ হয় না। এটা কেন?
- স্বপ্নদোষ হওয়া যেমন স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া, তেমনি না হওয়াও একদমই স্বাভাবিক বিষয়।
অন্ডকোষ কর্মক্ষম থাকলে প্রতি সেকেন্ডে ১১ হাজার শুক্রানু তৈরী হয়। সাথে বিভিন্ন গ্রন্থীর নিঃসরণ মিলে সৃষ্টি হয় বীর্য। বীর্যে থাকে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান। সাধারণ অবস্থায় দরকারি উপাদান গুলো শরীর শোষণ করে নেয়। অবশিষ্ট অংশ "Phagocytosis" প্রক্রিয়ায় নিঃশেষ হয়ে যায়। এরপরও যা বাকি থাকে তা স্বপ্ন দেখে বা স্বপ্ন দেখা ছাড়াই বের হয়ে আসে। কারো যদি বীর্যের উপাদান গুলো শরীরে শোষিত হওয়ার পর অবশিষ্ট অংশ "Phagocytosis" প্রক্রিয়ায় ব্যালেন্স হয়ে যায়, তাহলে তার আর স্বপ্নদোষ হবে না।
সুতরাং, কারো প্রতিদিন স্বপ্নদোষ হওয়া যেমন তার জন্য স্বাভাবিক তেমনি কারো কখনোই স্বপ্নদোষ না হওয়া ও নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাভাবিক।
আগে তো এমন ছিলো না! এখন এত ঘন ঘন হয় কেন? / এখন আর হয়না কেন?
- দেখুন, আমাদের দেহ এক বিশাল সুপার কম্পিউটারের চেয়েও বেশি সফিস্টিকেইটেড সিস্টেম দিয়ে প্রোগ্রাম করা। এর প্রতিটা ফাংশন একটার সাথে অন্যটা রিলেটেড। প্রতি মুহূর্তে দেহে হাজারটা বায়োকেমিক্যাল রিঅ্যাকশন হচ্ছে, বায়োফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি ঘটে যাচ্ছে, স্নায়োবিক সিগনাল ট্রান্সডিউস হচ্ছে... এসবের সাথে নিবিড় সম্পর্ক আমাদের জীবনাচরণ, খাদ্যাভ্যাস ও পরিবেশের। এসবের কোনটার পরিবর্তন এর ফলেই এখন দেহের হরমোনাল আর মেটাবলিক ফাংশন চেঞ্জ হয়েছে। এখন নিজ নিয়মেই এটা আবার ক্রমান্বয়ে আগের মত হয়ে যেতে পারে বা এর কম-বেশি করে বা একই রকম থেকে "সেট" হয়ে যেতে পারে! এই পরিবর্তনটাও "ফিজিওলজিক্যাল"।
কিন্তু, আমার যে ক্ষতি হচ্ছে? শরীর ভেঙে যাচ্ছে। আমি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি!
- সত্যি কথা বলতে; গা ম্যাজম্যাজ করা, দুর্বল দুর্বল লাগা, কিছু মনে থাকে না, পড়ায় মন বসেনা ইত্যাদি সমস্যা গুলো স্বপ্নদোষের জন্য নয়। স্বপ্নদোষকে "দোষ" মনে করার জন্য। মানে "মানসিক" যে বোঝা আপনি বয়ে বেড়াচ্ছেন তাই আপনার শান্তি কেড়ে নিচ্ছে। তবে হ্যা, যদি পর্ণ আসক্তি, হস্তমৈথুন, বিকৃত যৌনাচার বা অনুরূপ বাজে অভ্যাসগুলো ছাড়া কেবল "স্বপ্নদোষ" হতে হতে শরীরের ওজন কমে যায়, গাল-চাপা ভেঙে যায়, চোখ গর্তে ঢুকে যায়, দৃষ্টি ঝাপসা হয় তবে তা "স্বপ্নদোষ" এর জন্য না। অন্য কোন রোগের জন্য। এক্ষেত্রে আপনার "মেডিসিন স্পেশালিষ্ট" এর স্বরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন।
আর যদি উপরোক্ত বাজে অভ্যাস থেকে থাকে তাহলে তো বুঝতেই পারছেন! আগে এসব একদম বাদ দিতে হবে। বাদ মানে পুরোপুরি বাদ। আর একবারও করা যাবে না। এরপর বডির নিজস্ব ম্যাকানিজমে ঠিক হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ধৈর্যের বিকল্প নেই- বহুদিনের ক্ষয় রাতারাতি পূরন হয় না। মনে রাখবেন - একদিনে সব হয়না, তবে একদিন সব হবে।
স্বপ্নদোষ হতে হতে বীর্য একদম পাতলা হয়ে গেছে! বিয়ে করতে ভয় পাচ্ছি!
- আগে বুঝুন, বীর্য আর শুক্রানু এক জিনিস নয়। বীর্য বা Semen এ থাকে প্রস্টেট এর নিসৃত তরল, সেমিনাল ভেসিকল নামক গ্লান্ডের নিঃসরণ, কাওপারস্ গ্লান্ড নামক গ্রন্থীর সিক্রেশন, কেমিক্যাল পদার্থ যেমন ফ্রুক্টোজ, শ্বেত রক্ত কনিকা এবং শুক্রানু বা Sperm.
অর্থাৎ, বেশিরভাগই তরল পদার্থ, সামান্য স্পার্ম (এই সামান্যই ৪০-৩০০ মিলিয়ন)। আর স্পার্ম ম্যাচিউর হতেও একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ সময় লাগে। তার মানে বার বার স্বপ্নদোষ হয়ে বীর্য পাতলা হওয়া মানে হল- শুক্রানু বা Sperm আসলে তেমন যাচ্ছেনা, বাকি তরল অংশটাই বের হয়ে যাচ্ছে। এজন্যই মেডিকেল সাইন্স ব্যাপারটাকে "নরমাল" বলে।
আর বিয়ে করতে ভয় কিসের? বিয়ের পর বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বপ্নদোষ বন্ধ হয়ে যায় বা অনেক কমে যায়। তাহলে বাকি টেনশন স্পার্ম নিয়ে? আরে ভাই, স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র মিলন আর স্বপ্নদোষ কি এক? স্বাভাবিক মাত্রার মিলন, পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার আর স্বাস্থ্যকর লাইফস্টাইল অনুসরণ করুন। দেখবেন সব ঠিক। মনে রাখবেন ৪০ বা ৩০০ মিলিয়ন নয়, সুস্থ - সচল একটা স্পার্মই প্রেগনেন্সির কারন হয়!
স্বপ্নদোষ হলে কি গুনাহ হবে?
- না। তবে আপনি এ অবস্থায় অপবিত্র। পরিপূর্ণভাবে গোসল (যেটাকে আমরা ফরজ গোসল বলে থাকি) না করলে আপনার সালাত আদায় হবে না।
বুঝলাম ভাই। এটা রোগ না, তাই চিকিৎসাও নাই। কিন্তু মন তো মানেনা! এটা কমানোর উপায় বলেন?
- জ্বী, এটা রোগ না। কিন্তু "অল্টার্ড ফিজিওলজি"! আর এর চিকিৎসা আছে। ভুলে গেলে চলবেনা- চিকিৎসা মানেই "ঔষধ" নয়। লাইফ মোডিফিকেশন অ্যাডভাইসও চিকিৎসার অংশ!
আপনার চিকিৎসা ৪ টি
১. মানসিক ও শারিরীক স্থিরতা আনুন
- এটাকে রোগ/পাপ/খারাপ কিছু ভাবা বাদ দিন। মানসিক ভাবে চাঙ্গা থাকুন।
- যে কোন যৌন চিন্তা, সেক্স ফ্যান্টাসি, অহেতুক উত্তেজনা পরিহার করুন।
- দেহ মাত্রাতিরিক্ত ক্লান্ত হয়, এমন কাজ করবেন না।
- সাধারণ Free Hand Exercise (ইনস্ট্রুমেন্ট ছাড়া খালি হাতে সাধারণ শরীরচর্চা) করুন। যেমন, হাঁটা, জগিং, হাই স্টেপিং, স্কোয়াটিং, মাউন্টেইন ক্লাইম্বার, পুশ আপ, প্লাংক এসব। নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী, খুব বেশি ক্লান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত।
২. লাইফ স্টাইল বদলান
- টাইট পোশাক পড়বেন না। ঢিলে ঢালা জামা পড়ুন।
- রাতে ঘুমানোর কমপক্ষে ১ ঘন্টা আগে খাওয়া ও পানি পান শেষ করবেন।
- ঘুমানোর আগে ভালো ভাবে প্রস্রাব করে ওজু করে ঘুমাবেন।
- রাত জাগবেন না। উপুর হয়ে ঘুমাবেন না। কোল বালিশ ব্যবহার করবেন না। ভোরে উঠে যাবেন। একবার ঘুম ভাঙার পর "গড়াগড়ি" করা একদম নিষেধ।
- স্বপ্নদোষ হয়ে গেলে ভুলেও পর্ণ দেখবেন না, মাস্টারবেট করবেন না। দ্রুত বিছানা ছেড়ে গোসল করে নিন। মন খারাপ করে শুয়ে বসে থাকবেন না।
যেদিন স্বপ্নদোষ হবে সেদিন একটু সতর্ক থাকুন। বিছানা থেকে দূরে থাকবেন যতটুকু পারেন, একা অলস সময় কাটাবেন না। বাহিরে ঘোরাঘুরি করবেন। খেলাধুলা করবেন। ভালো বন্ধু, বাবা মা, ভাইবোনদের সাথে সময় কাটাবেন।
- কখনোই সম্পূর্ণ উলঙ্গ হবেন না। এমনকি গোসল বা টয়লেট এ ও না। গোসল করার সময় বিশেষ করে লজ্জাস্থান ধোয়ার সময় খুব সাবধান থাকবেন।
৩. পুষ্টিকর খাবার খেয়ে ক্ষয়পুরন করে ফেলুন
- দুধ, ডিম ও মাংস খাবেন।
- কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখতে গুরুপাক খাবার, তেল-চর্বি, ভাজাপোড়া বাদ দিবেন। পেপে সহ অন্যান্ন ফল ও শাকসব্জি বেশি করে খাবেন।
- কালোজিরা, মধু, খেজুর, ভেজা ছোলা, কিসমিস, বাদাম নিয়ম করে খাবেন।
- পর্যাপ্ত পানি পান করবেন। ইসুব গুলের ভূষি খাবেন।
৪. বিশ্বাসের সাথে আমল করুন
- ঘুমের আগে আয়াতুল কুরসি পড়া, সূরা ইখলাস, ফালাক, নাস তিনবার করে পড়ে শরীর মাসেহ করা, ঘুমানোর দুআ ও অন্যান্য যিকর আযকার,গুলো করে হৃদয়টাকে ঠান্ডা করুন।
- বাথরুম, গোসলখানায় প্রবেশ ও বের হয়ে মাসনূন দোয়া পড়বেন।
- ডান কাত হয়ে শোবেন।
- আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা আমাদেরকে হেফাযত করুন। আমীন
জনসচেতনতায় পোস্ট টা শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন।
إرسال تعليق